পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার। তারা নিজেদেরকে মানবাধিকারের প্রবক্তা মনে করে গোটা দুনিয়াকে মানুষের অধিকারের সবক দেন। ইতিহাস প্রমাণ করে, দেশে দেশে তারাই সবচেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। পশ্চিমা দেশগুলোতে মানবাধিকারের ধারণাটি সাম্প্রতিক বলে মনে করা হয়।
সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো এ সত্যের সাক্ষ্য দেয় যে, জাতিসঙ্ঘ সম্ভবত মার্কিন কৌশলগত স্বার্থ হাসিলে একটি প্রচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করতে পছন্দ করেছে বা নীরব দর্শক থেকেছে। অমানবিক নিবর্তন, গণহত্যা, নৃশংসতা ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিষয়ে কিছু মৃদু বিবৃতি দেয়া ছাড়া জাতিসঙ্ঘ কিছুই করেনি। কাশ্মিরের অধিকারকামী জনগণের প্রতি ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নিপীড়ন, ফিলিস্তিনিদের নির্বাসনে ইহুদি আগ্রাসন, সার্বিয়ান কসাইয়ের হাতে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার জনগণের হত্যাযজ্ঞ, তামিল জঙ্গিদের গুলির মুখে শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের বাস্তুচ্যুতি, নাগরনো-কারাবাখ ছিটমহলের বন্দী বাসিন্দাদের প্রতি খ্রিষ্টান আর্মেনীয়দের ভয়ঙ্কর আচরণ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক আরাকানের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশইন, তুর্কি সাইপ্রাসের দুর্ভাগা জনগণের দুর্ভোগ নিরসন, সিরিয়া এবং আফ্রিকার সিয়েরা লিওন, গিনি, আইভরিকোস্ট ও ঘানার লাইবেরিয়ান মুসলিম উদ্বাস্তুদের সমস্যাগুলোর প্রতি জাতিসঙ্ঘ উদাসীন ছিল।
উল্লিখিত লোমহর্ষক ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, জাতিসঙ্ঘের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সীমিত। এমনকি ইসরাইল, ভারত, আর্মেনিয়া ও সার্বিয়ার জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ অনুভব করেনি এই বিশ্ব সংস্থা। মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণা বাস্তবায়িত না হওয়ায় জাতিসঙ্ঘের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের সহায়তায় মানবাধিকার নিয়ে বৈশি^ক রাজনীতিতে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বজায় রাখছে। এ কারণেই জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার ঘোষণার ৩০তম বার্ষিকীতে জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব পেরেজ ডি কুয়েলার দুঃখের সাথে মন্তব্য করেন, ‘আমরা এখনো আমাদের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। বিশ্বের অনেক জায়গায়, মানুষ এখনো বেঁচে থাকার মৌলিক উপায় থেকে বঞ্চিত। তাদের শারীরিক, মানসিক অখণ্ড মনোযোগের ওপর এখনো আক্রমণ করা হয়। জাতিগত বৈষম্যের বিভিন্ন রূপ, নির্যাতনের চর্চা, বিনাবিচারে আটক, সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ড এগুলোর কিছুই এখনো বিশ্বসমাজে একটি অপরিচিত ঘটনা হয়ে ওঠেনি।’
অপরদিকে ইসলাম অর্থ আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া, কোনো কিছু মাথা পেতে নেওয়া। এ শব্দটি সালম, সিলম বা সিলমুন মূল ধাতু থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ইসলাম শব্দের মূল ধাতু ‘সালম’, যার অর্থ শান্তি, সন্ধি, সমর্পণ ও নিরাপত্তা। যেহেতু আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ হয়, তাই একে ইসলাম বলা হয়। অন্য কথায়, ইসলামের অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তার নির্দেশ মান্য করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন করা। ইসলাম গ্রহণ করার ফলে নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করতে হয়। ইসলামের মূল মর্মবাণী হলো মানুষের সর্বস্ব আল্লাহতায়ালার কাছে সোপর্দ করে দেওয়া। তার সব শক্তি, তার যাবতীয় কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাব-আবেগ, তার সব প্রিয় বস্তু- এক কথায় মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত যত কিছু আছে, সবকিছুকে আল্লাহতায়ালার কাছে অর্পণ করার নামই হলো ইসলাম। কোরআনের ভাষায়, ইসলাম মানে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা।
আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বাধ্যতা স্বীকার করে নেওয়া যে জীবনাদর্শের লক্ষ্য তারই নাম ইসলাম। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতিস্তরে আল্লাহর বিধিনিষেধ পালন করা, তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা-এ লক্ষ্যে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার নামই ইসলাম। সমাজ ও রাষ্ট্রকে অশান্তি, জুলুম ও বিশৃঙ্খলামুক্ত করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে বলেই ইসলাম শান্তির আদর্শ। মানুষ যদি সত্যিই শান্তি পেতে চায়, তাহলে তার নিজের ইচ্ছামতো জীবনযাপন না করে আল্লাহর দেওয়া বিধান মেনে চলতে হবে। তাই আল্লাহ তার প্রেরিত বিধানের নাম রেখেছেন ইসলাম বা শান্তি। ইসলাম শব্দটির অর্থের মধ্যে বিশেষ গুণের পরিচয় পরিস্টম্ফুটিত। ইসলামের তুলনা ইসলাম কেবল নিজেই। নাম থেকেই বোঝা যায় যে, ইসলাম কোনো ব্যক্তিবিশেষের আবিস্কার নয়, কোনো জাতির নামানুসারেও এ মতাদর্শের নাম হয়নি। ইসলাম নামটি আল্লাহ প্রদত্ত। তাই ইসলাম নামটি অনেক গুরুত্ব বহন করে। ইসলামের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক সুগভীর।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। সব সংঘাত-সংঘর্ষের চিরন্তন ও মহাসমন্বয় হচ্ছে ইসলাম। জীবনাদর্শ, জীবন ব্যবস্থা ও জীবন বিধান হিসেবে ইসলামে রয়েছে সব সমস্যার সঠিক সমাধান। এতে রয়েছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি সমস্যার সমাধান আর মৃত্যুর পর আখেরাতের অনন্ত জীবনে নিশ্চিত সুখ-শান্তি লাভের উপায়। ইসলাম মানুষের চলার পথের সন্ধানদাতা, উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন তথা মানবজীবনের চরম লক্ষ্য হাসিলের একমাত্র পন্থা। এর ব্যাপ্তি জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধিকার। তাই ইসলাম মানুষের সঠিক পথের দিশারি, দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বাঙ্গীণ ও পূর্ণাঙ্গ একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে সুরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইসলামই আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনাদর্শ।’ অপর এক স্থানে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের ওপর আমার যাবতীয় নিয়ামত সম্পন্ন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম’ (সুরা আল মায়েদা :৩)। এ আয়াতদ্বয় থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, আল্লাহ ইসলামকে মানবতার জন্য নিয়ামত হিসেবে পাঠিয়েছেন, যাতে মানুষের জীবনের সব সমস্যার সমাধান রয়েছে।
ইসলাম গ্রহণ করলে আমরা আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন বান্দা ইসলাম গ্রহণ করে আর তার ইসলাম খাঁটি হয়, আল্লাহ তা দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত করে দেন সে পূর্বে যা অপরাধ করেছে। অতঃপর তার সৎ কাজ হয় অসৎ কাজের বিনিময়, সৎ কাজ তার দশগুণ থেকে সাতশ’ গুণ বরং বহু গুণ পর্যন্ত আর অসৎ কাজ তার একগুণ মাত্র। তবে আল্লাহ যাকে ছেড়ে দেন তার একগুণের শাস্তিও হবে না’ (বোখারি)। আসলে কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করে, তাহলে মূলত সে নিজেকেই অনুগ্রহিত করে থাকে। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা ইসলাম গ্রহণ করে তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছে বলে মনে করে। তুমি বলো, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ বলে জাহির করো না। পক্ষান্তরে তোমাদের মুমিন হওয়ার দাবিতে তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে এ কথা স্বীকার করো। আল্লাহই প্রকৃত ইমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের ওপরই অনুগ্রহ করেছেন’ (সুরা আল হুজুরাত :১৭)।